লক্ষ্মণসেন (আনু. ১১৭৮-১২০৬ খ্রি) সেন বংশের তৃতীয় শাসক। বল্লালসেনের উত্তরসূরী লক্ষ্মণসেন প্রায় ২৮ বছর রাজত্ব করেন। এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত লক্ষ্মণসেনের সময়কার লিপিসাক্ষ্য হতে তাঁর ইতিহাস পুনর্গঠন করা হয়েছে।
লক্ষ্মণসেনের সময়ের সাক্ষ্যপ্রমাণ হতে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি ক্ষমতায় আরোহণের পূর্বেই গৌড় ও বারাণসীর (কাশী) রাজাকে পরাজিত এবং কামরূপ ও কলিঙ্গের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। উক্ত বিজয়গুলি লক্ষ্মণসেনের যুবা বয়সে অর্জিত বলে ধারণা করা হয় এবং সম্ভবত অভিযানগুলি ছিল তাঁর পিতামহ বিজয়সেনের সময়ের। কেননা বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় বিজয়সেন গৌড়, কলিঙ্গ, কামরূপের রাজা এবং খুব সম্ভবত কাশীর গাহাড়বাল বংশের রাজার বিরুদ্ধেও যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। লক্ষ্মণসেনের লিপি সাক্ষ্য হতে দেখা যায় যে, তিনিই সেনদের মধ্যে প্রথম রাজা যিনি ‘গৌড়েশ্বর’ উপাধি ধারণ করেন। বিজয়সেন ও বল্লালসেন কারো কোন তাম্রশাসনেই এ উপাধি ধারণের উল্লেখ পাওয়া যায় না। এ কারণে যুক্তি দেওয়া হয় যে, লক্ষ্মণসেনই শেষ পর্যন্ত গৌড় পদানত করেন এবং নিজে ‘গৌড়েশ্বর’ উপাধি গ্রহণ করেন। কিন্তু এ যুক্তি একান্তই দুর্বল, কারণ বিজয়সেনের শাসনকালেই সমগ্র বাংলার উপর সেনদের আধিপত্য স্থাপিত হয়েছিল। তাছাড়া সেনদের দলিলপত্রে এমন কোন ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় না যে, লক্ষ্মণসেন গৌড় পুনর্দখল করার প্রয়োজন অনুভব করেন। তদুপরি বিজয়সেন ও বল্লালসেনের শাসনকালে সেনদের দ্বারা উত্তর বাংলা দখলের বিষয়টি প্রশ্নাতীতভাবেই প্রমাণিত।
তাম্রশাসন সূত্রে জানা যায় যে, লক্ষ্মণসেন পুরী, বারাণসী ও এলাহাবাদে তাঁর বিজয়ের চিহ্ন হিসেবে সৌধমালা নির্মাণ করেন। কিন্তু তাম্রশাসনে লক্ষ্মণসেনের যে উচ্চ প্রশংসা করা হয়েছে তা থেকে এ সিদ্ধান্ত করা খুবই কঠিন যে, আলোচ্য সৌধমালা লক্ষ্মণসেনের শাসনকালে উপরোল্লিখিত এলাকায় সেনদের ক্ষমতা সম্প্রসারণেরই প্রমাণ দেয়। লক্ষ্মণসেনের সভাকবি উমাপতি ধর এবং শরণ একজন বেনামি রাজার বিজয়াভিযানের উল্লেখ করেছেন যিনি প্রাগজ্যোতিষ, গৌড়, কলিঙ্গ, কাশী, ও মগধ দখল এবং চেদি ও ম্লেচ্ছরাজকে পরাজিত করেছিলেন। চেদি এবং ম্লেচ্ছগণ ব্যতীত উল্লিখিত অন্যান্য প্রশংসা সম্ভবত লক্ষ্মণসেনের ওপরই আরোপ করা হয়েছে। রত্নপুরের কলচুরিরাজের (চেদি) সামন্ত বল্লভরাজ গৌড়রাজকে পরাভূত করেছিলেন, অকালতারা শিলালিপিতে (Akaltara inscription) এরূপ উল্লেখ আছে। অন্যদিকে লক্ষ্মণসেন দাবি করেন যে, চেদিরাজের বিরুদ্ধে তিনি বিজয় অর্জন করেছিলেন। যদিও এই দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা মোটামুটিভাবে নিশ্চিত, তবে ফলাফল সম্বন্ধে সঠিক তথ্য জানা যায় না।
এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, লক্ষ্মণসেন অতি বৃদ্ধ বয়সে সিংহাসনে আরোহণ করেন। উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের জন্য তাঁর শাসনকাল বিখ্যাত। তিনি নিজেও অনেকগুলি সংস্কৃত কবিতা রচনা করেন যার বেশ কয়েকটি সংস্কৃত কাব্যসংকলন সদুক্তিকর্ণামৃত গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। পিতার শুরু করা গ্রন্থ অদ্ভুতসাগর তিনি সম্পন্ন করেন। তাঁর রাজসভায় পন্ডিত ও জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গের সমাবেশ ঘটেছিল। গীতগোবিন্দ রচয়িতা বিখ্যাত কবি জয়দেব, শরণ, পবনদূত রচয়িতা ধোয়ীএবং সম্ভবত গোবর্ধন আচার্য তাঁর সভা অলঙ্কৃত করতেন। বটুদাসের পুত্র শ্রীধরদাস সংস্কৃত কাব্যগ্রন্থ সদুক্তিকর্ণামৃত সংকলন করেন তাঁরই শাসনকালে। লক্ষ্মণসেনের প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারক হলায়ুধ মিশ্র রচনা করেন ব্রাক্ষ্মণসর্বস্ব। দেওপাড়া প্রশস্তি রচয়িতা উমাপতি ধর লক্ষ্মণসেনের একজন মন্ত্রী এবং অন্যতম সভাকবি ছিলেন।
#biography
#viralvideo
#history
#information
16 мар 2024