বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে শুভ অক্ষয় তৃতীয়ায় সমাধি ক্ষেত্র মন্দির চৌমুহনীতে শ্রীশ্রীঠাকুর রামচন্দ্রদেবের সমাধি স্নান অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আজ সকাল ৬.১৫ মিনিটে শ্রীশ্রী কৈবল্যনাথের মোহন্ত মহারাজ পূজ্যপাদ শ্রীমৎ কালীপদ ভট্টাচার্য্য মহাশয়ের পৌরোহিত্যে এই আয়োজন সুসম্পন্ন হয়।
১৩৪৯ সনের আষাঢ় মাসে শ্রীশ্রীঠাকুর কলিকাতায় শ্রীযুক্ত উপেন্দ্র সাহাকে জানাইলেন যে তাঁহার কিছুদিন খুব নিরিবিলি থাকার প্রয়োজন। এই কথা শুনিয়া শ্রীযুক্ত উপেন্দ্র সাহা তাঁহাকে জানাইল যে চৌমুহনীতে তাহাদের একটি বাংলো খালি পড়িয়া আছে। ঠাকুর দয়া করিয়া তথায় থাকিতে ইচ্ছা করিলে তাহারা অবিলম্বে তথায় তাঁহার বাসস্থানের ব্যবস্থা করিতে পারে। শ্রীশ্রীঠাকুরের সম্মতি সাপেক্ষে শ্রীযুক্ত উপেন্দ্রবাবু তাঁহার পরম স্নেহাস্পদ ভ্রাতা শ্রীযুক্ত নরেন ভূঁইয়াকে অতিসত্তর প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নিতে বলেন এবং বাংলোটির প্রয়োজনীয় কিছুটা সংস্কার করিয়া তিন-চার দিনের মধ্যেই বাসপোযোগী করিয়া তুলেন।
উপেন্দ্রবাবু শ্রীশ্রীঠাকুরকে নিয়ে সেই বাংলোবাড়িতে উপস্থিত হইলেন। সেই সময় হইতে প্রায় সাত বৎসর অর্থাৎ ১৩৫৬ বাং সনের ১৮ই বৈশাখ তাঁহার তিরোধানের দিন পর্য্যন্ত অধিকাংশ সময়ই তিনি ঐ স্থানেই বাস করিয়াছেন, যদিও অল্প কয়েকদিনের জন্য তিনি এ জেলার ও অন্যান্য জেলার কোনও কোনও স্থানে মাঝে মাঝে যাতায়ত করিতেন।
শ্রীশ্রীঠাকুর এই স্থানে পদার্পন করার পর কয়েক মাস ঐ বাংলোর ও কম্পাউন্ডের দরজা প্রায় সকল সময়েই বন্ধ থাকিত। নেহাৎ সেবাকারী ছাড়া অন্য সকলেরই বাংলোতে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। ক্রমে বহুদূরাগত ভক্তদের মনোবাসনা পূরণের জন্য অথবা অন্য কারণে যাহা একমাত্র ঠাকুরই জানেন ঐ রুদ্ধ দ্বার মাঝে মাঝে খুলিতে লাগিল। এই স্থানে থাকাকালে ঠাকুর ভোরে উঠিয়া হাতমুখ ধোওয়ার পর কিছুকাল ঘরের বারান্দায় পায়চারি করিতেন। তৎপর একখানা বাংলা সংবাদপত্র পড়িতেন। কেহ তাঁহার দর্শন অথবা উপদেশবাণী শ্রবণ করিবার জন্য আসিলে অনতিবিলম্বে ঐ পত্রিকা পড়া বন্ধ করিয়া তাহাকে তাঁহার প্রার্থনানুযায়ী উপদেশ দিতেন। নেহাৎ অসুস্থ না হইলে প্রাতে প্রায় এগারোটার সময় কথা বন্ধ করিয়া শ্রীশ্রীঠাকুর উপস্থিত ভক্তগণকে আহার করার জন্য শ্রীযুক্ত উপেন্দ্র অথবা নরেন ভূঁইয়ার বাড়িতে যাইতে বলিতেন। সময় সময় ইহাও বলিতেন যে, ঐ বাড়ীও আপনাদেরই। সুতরাং সংকোচের কোনও কারণ নাই, ভক্তগণও ঐ নির্দ্দেশ অনুযায়ী তাঁহাদের সাদর আতিথ্য গ্রহণ করিয়া পরম তৃপ্তিলাভ করিত।
১৩৫৬ বঙ্গাব্দের ১৮ই বৈশাখ, রবিবার পুণ্য অক্ষয় তৃতীয়া তিথিতে মাহেন্দ্রক্ষণে ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের পহেলা মে অগণিত ভক্তের প্রাণের ঠাকুর নশ্বর দেহ ত্যাগ করিয়া অপ্রকট হইলেন। ৯০ বৎসর পূর্বে এই শুভ অক্ষয় তৃতীয়ায় তিনি মাতৃজঠরে প্রবিষ্ট হইয়াছিলেন, ঠাকুর নিজ মুখেই ইহা ব্যক্ত করিয়াছিলেন। দেহরক্ষার পূর্ব দিন রাত্রিতে ঠাকুর যখন শয়ন করিবেন, তাহার পূর্বক্ষণে উপেন বাবু ও নরেন বাবুকে বলিলেন, “গত রাত্রিশেষে আমি তন্দ্রার ঘোরে দেখিলাম চন্দ্রলোক হইতে একখানা রথ নামিয়া আসিল, আমি তাহাতে উঠিয়া এখান হইতে চলিয়া গেলাম।” ঠাকুর পদ্মহস্ত তাঁহাদের মাথায় রাখিয়া আশীর্বাদ জানাইলেন, কখন বা চিবুক ধরিয়া আদর জানাইলেন এবং মঙ্গল কামনা করিলেন।
পরদিন প্রাতে ঠাকুর সম্পূর্ণরূপে উলঙ্গ হইয়া শুইয়া আছেন - কণ্ঠের তুলসীর মালা, পরিধানের কৌপিন ও বহির্বাস, গায়ের অঙ্গ রাখা ইত্যাদি ইহলোকের যাবতীয় বেশভূষা মেঝের উপর পড়িয়া আছে। তিনি যেন ইহসংসারের সর্বপ্রকার বন্ধন হইতে মুক্ত - যে কাজে আসিয়াছিলেন সে কাজই পুনরায় গ্রহণ করিয়াছেন। উত্তর শিয়র হইয়া শুইয়া আছেন। শরীরে বিশেষ কোন গ্লানি আছে বলিয়া মনে হইল না। উপেন বাবু পাশে বসিয়া ঠাকুরের অনুমতি সাপেক্ষে মকরধ্বজ দিতেছিলেন। হঠাৎ দেখিলেন ঠাকুরের দেহ অসাড়, গলায় একটু ঘড় ঘড় শব্দ শুনিতে পাইলেন। তৎক্ষণাৎ ডাক্তার ডাকা হইল। তিনি পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন প্রাণবায়ু চলিয়া গিয়াছে। মুহূর্তে প্রলয় ঘটিয়া গেল। সে শোকাবহ বার্তা চারিদিকে বিস্তৃত হইয়া পড়িল। দেখিতে দেখিতে সহস্র নর-নারী ঠাকুরের পরিত্যক্ত দেহ শেষ দেখার জন্য বাংলোর আঙ্গিনায় আসিয়া উপস্থিত হইল। টেলিগ্রামে দূরবর্তী স্থানে সংবাদ পাঠান হইল। দূরাগত ভক্তগণ শেষ দর্শনে বঞ্চিত না হন - সে উদ্দেশ্যে দুইদিন পর্যন্ত দেহ রাখিয়া দেওয়া হইল। ঐ দুই দিবস দেহ কোমল ও অবিকৃত রহিল। মনে হইল ঠাকুর যেন শান্তিতে নিদ্রা যাইতেছেন।
ঠাকুরের পাঞ্চভৌতিক দেহ দাহ কি সমাধিস্থ করা হইবে এবং সে কার্যটি কোথায় সম্পন্ন করা হইবে, এই প্রশ্নের সমাধান বিষয়ে ভক্তগণের মতভেদ উপস্থিত হইল। উপেন্দ্র বাবু ও নরেন্দ্র বাবু বলিলেন, ঠাকুর একদিন বলিয়াছিলেন তাঁহার দেহ যেন চৌমুহনী আশ্রমেই সমাধিস্থ করা হয়। পক্ষান্তরে ফেনীর ভক্তগণ বলিলেন, ঠাকুর বলিয়াছিলেন, “দেহ হইতে প্রাণ বাহির হইয়া গেলে এই পাঞ্চভৌতিক দেহ ত্যজ্য পদার্থে পরিণত হয়, তখন ইচ্ছা হয় ইহা মাটিতে পুঁথিয়া রাখেন, ইচ্ছা হয় নদীতে ভাসাইয়া দেন, ইচ্ছা হয় আগুনে ভষ্ম করিয়া ফেলেন।” ঠাকুরের কথায় এইরূপ ইঙ্গিত ছিল যে, তাঁহার দেহ ফেনীর মাটিতেই রাখা হয়। মোহন্ত মহারাজ শ্রীমৎ শ্যামাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের উপর এই সমস্যা সমাধানের ভার ন্যস্ত হইল। তিনি কিয়ৎকাল ধ্যানস্থ থাকিয়া এই প্রত্যাদেশ পাইলেন যে, চৌমুহনীতেই সমাধিস্থ করা হইবে। সকলে সন্তুষ্ট চিত্তে এই মীমাংসাই স্বীকার করিয়া লইলেন।
বাংলোর যে কক্ষে ঠাকুর বাস করিতেন সে কক্ষই সর্বসম্মতিক্রমে সমাধিক্ষেত্র নির্বাচিত হইল। অতি অল্প সময়ের মধ্যে তাঁহারই কৃপায় চারি হাত দৈর্ঘ্য, চারি হাত প্রস্থ ও চারি হাত গভীর একটি গর্ত করিয়া এবং তাহার চতুর্দিক ও নিম্নভাগ ইট, সুরকী ও সিমেন্ট ইত্যাদি দ্বারা বেশ শক্ত করিয়া বাঁধাইয়া, ঠাকুর যে খাটে, যে শয্যায় এবং যে মশারীর নীচে শয়ন করিতেন সেই সব জিনিষ সহ এবং তাঁহার নিত্য ব্যবহার্য আরও কতকগুলি জিনিষ পাশে রাখিয়া চিরভক্ত বাঞ্ছিত পবিত্র দেহ সমাধিস্থ করা হইল। এবং গৃহ ভিত্তি হইতে দুই হাত উচ্চ এক বেদি নির্মাণ করিয়া সমাধি ঢাকিয়া দেওয়া হইল।
9 май 2024