‘ষাটের দশকে জর্জদা’-র পঞ্চদশতম অধ্যায় আজ আপনাদের সামনে উপস্থিত করছি। প্রতি পর্বে আপনাদের সামনে অজানা অচেনা দেবব্রত বিশ্বাস কে হাজির করি আমার এই দুর্বল লেখনির মাধ্যমে। এখন ভাবছি পাশাপাশি অজানা অচেনা রবীন্দ্রনাথের কথাও কিছু কিছু আপনাদের বলি। এই পর্ব থেকে দেবব্রত বিশ্বাসের পাশাপাশি আপনাদের রবীন্দ্রনাথের জীবনের কিছু টুকরো ঘটনা বলবো যার থেকে মানুষ রবীন্দ্রনাথের একটা ছবি আপনাদের মনে চিত্রায়িত হবে।
তাঁর অটল গাম্ভীর্যের পেছনে যে রসিক পুরুষটি লুকিয়ে থাকতেন, তার খবর খুব কম লোকেই পেয়েছেন। সীতা দেবী তার ‘পুণ্যস্মৃতি’ গ্রন্থে তেমনি এক ঘটনার উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখছেন, "সন্ধ্যার পর যখন ফিরিয়া আসিতেছি তখনও দেখিলাম তিনি সেই ছাদেই বসিয়া আছেন। রাত্রি কালে হয়তো দেখা হইবে না তাই এখনই বিদায় লইয়া রাখিবার জন্য উপরে গিয়া উঠিলাম। বাড়ির সামনের পথ দিয়া দুইজন ছেলে কথা বলিতে বলিতে যাইতেছিল, তাহারা যে কে অন্ধকারে দেখা গেল না। ভূতের গল্পই হইতেছিল বোধহয়। একজন বলিল, ‘কিছু না শুনলেও, অশথ কি বটগাছের তলায় এলেই...’ শুনিতে পাইয়া উপর হইতে রবীন্দ্রনাথ বলিলেন, ‘কেমন গা টা ছমছম করে, না?’ ছেলে দুইটি তৎক্ষণাৎ পলায়ন করিল।”
আরেক জায়গায় সীতা দেবী লিখছেন, “এই সময় ‘নিরেট গুরুর কাহিনী’ নামক একটি ছোট ছেলেদের গল্পের বই লিখিয়াছিলাম। বই বাহির হইতেই রবীন্দ্রনাথকে একখানি কপি পাঠাইয়াছিলাম। দার্জিলিং হইতে তাহার উত্তর পাইলাম। তিনি রসিকতা করিয়া জানিতে চাহিয়াছিলেন বইটি আমি তাহাকেই লক্ষ্য করিয়া লিখিয়াছি কিনা। গল্প গুলি হইতে তিনি নাকি একটি সদুপদেশ পাইয়াছেন যে, পা কখনো ঠান্ডা হইতে দেওয়া উচিত নয়, এইজন্য তিনি স্বয়ং সর্বদাই খুব গরম মোজা পরিয়া থাকেন। দার্জিলিং হইতে ফিরিয়া আমাকে আবার সেই গল্পের বই লইয়া ঠাট্টা করিয়া বলিলেন, “আচ্ছা, আমি যে তোমার বই সম্বন্ধে অত সন্দেহ প্রকাশ করে চিঠি লিখলুম, তা কই তুমি তো আমায় কোনরকম আশ্বাস দিলে না যে আমাকে লক্ষ্য করে লেখ নি? এত লোক থাকতে তুমি গুরুদের আক্রমণ কর কেন?”
এবার আসি, জর্জদার গল্পে।
গত দুই পর্বে আমি ইন্দুভূষণ রায়ের স্মৃতিচারণা আপনাদের শুনিয়েছি। আজ ইন্দুভূষণ বাবুর স্মৃতিচারণার শেষ পর্ব।
শান্তিনিকেতন ছেড়ে কলকাতায় এসে ইন্দুভূষণ বাবু পাইওনিয়ার ব্যাঙ্কে unpaid apprentice হিসেবে যোগ দিলেন। তাঁর ভগ্নিপতির উপদেশে ব্যাংকিং সংক্রান্ত কিছু বই কিনে পড়াশোনাও শুরু করলেন। জর্জদা ছিলেন ইকোনমিক্সে এম এ। তাই ইন্দুভূষণ বাবুর মা জর্জদাকে অনুরোধ করলেন ইন্দুভূষণ বাবুকে কিছুটা পড়াশোনায় সাহায্য করতে। রোজ রাত্রে অফিস থেকে ফিরে জর্জাদা ইন্দুভূষণ বাবুকে পড়াতে বসতেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই বই বন্ধ করে শুরু করতেন গান। এবং তারপর সকলের চোখ এড়িয়ে দুজনে নাইট শোতে আলেয়া সিনেমায় চলে যেতেন এডি ক্যান্টার বা ফ্রেড অ্যাল্টেয়ার বা জিনজার রজার্সের গান ও ট্যাপ ড্যান্সের সিনেমায়! ইন্দুভূষণ বাবুর মা উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলে জর্জদার আশ্বাস বাণী ছিল, “ওর পড়াশোনায় ভয়ানক অমনোযোগ। তবে ভাববেন না, ও ঠিক হয়ে যাবে।”
ইন্দুভূষণ বাবু যখন প্রথম চাকরি পেয়ে অফিসে যোগদান করলেন, তখন অফিসের পরিচ্ছদ হিসেবে, তখনকার দিনের যে রেওয়াজ সেই অনুযায়ী ধুতি-পাঞ্জাবি পরা স্থির করলেন। দেবব্রত বিশ্বাস তাই দেখে বললেন, “খবরদার, ধুতি-পাঞ্জাবি পইরা অফিস যাবি না, তাহলে বরাবরই কেরাণী হইয়াই থাকবি - প্যান্ট পর।” ইন্দুভূষণ বাবু শান্তিনিকেতনের মানুষ; ধুতি-শার্ট পরায় অভ্যস্ত। আর জর্জদা পড়তেন কোট, প্যান্ট, টাই। ইন্দুভূষণ বাবু মৃদু আপত্তি তুলেছিলেন বটে তার কোন প্যান্ট নেই বলে, কিন্তু জর্জদার রুদ্রমূর্তির সামনে তা ধোপে টিকলো না। জর্জদা নিজের একটা জিন্সের প্যান্ট বার করে দিলেন ইন্দুভূষণ বাবুকে। যখনকার ঘটনা বলছি, সেটা ১৯৩৫ সাল; তখন জর্জদা বেশ মোটাসোটা গোলগাল মানুষ এবং ইন্দুভূষণ বাবু বেশ রোগা। জর্জদার ঢলঢলে প্যান্ট পরে ইন্দুভূষণ বাবুকে নেহাতই কিম্ভুতকিমাকার ও হাস্যকর লাগাতে ইন্দুভূষণ বাবু ঘোরতর আপত্তি তুললেন। উপরন্তু দেখা গেল সেই প্যান্ট ইন্দুভূষণ বাবুর কোমরেও খুবই ঢিলে হচ্ছে। জর্জদা, তাই দেখে নিজের একটা সরু নেকটাই বার করে দিয়ে বললেন, “এইটা কোমরে বেল্ট এর মত ধইরা বাইন্ধা ল।” এইসব দেখে বাড়ির আর সকলে হেসে কুটোপাটি। অগত্যা তখন জর্জদা বললেন, “যা দোকানে গিয়া কাটাইয়া, ঠিক কইরা আন।”
জর্জদা যখন হিন্দুস্তান ইনস্যুরেন্স এ কাজ করতেন, তখন বিজলী সিনেমার উল্টোদিকে একটি মেসে কিছুদিন ছিলেন। তার পাশের দুটি ঘরে থাকতেন তার দুই দাদা, বলাই বিশ্বাস ও কানাই বিশ্বাস। ইন্দুভূষণ বাবু সেই মেসে কিছুদিনের জন্য জর্জদার সঙ্গে এক ঘরে ছিলেন। জর্জদার ঘরে একটি তালা ভাঙ্গা তোরঙ্গ, ইতস্তত ছড়ানো ময়লা শার্ট প্যান্ট, একজোড়া জুতো, খালি সিগারেটের প্যাকেট, দেশলাই, লুঙ্গি আরো কত কি। আসবাব বলতে ঘরে প্রায় কিছুই নেই - একটি ছেঁড়া ময়লা তোষক ও একটি বালিশ আর একটি শতচ্ছিন্ন মাদূর। পাশের দুটি ঘরে জর্জদার দুই দাদা বলাইদা ও কানাই দা ছিলেন অত্যন্ত সাজানো, গোছানো, পরিছন্ন। বলাই বাবু একদিন আচমকা ঘরে ঢুকে এসে ইন্দুভূষণ বাবুকে রূঢ় স্বরে বললেন, “মশাই, আপনি তো ভদ্রলোকের সন্তান, শান্তিনিকেতনের ছাত্র, এই বর্বরটার সঙ্গে এক ঘরে বাস করতে ঘৃণা বোধ করেন না? মরার কাঁথার উপর শুয়ে থাকেন, লজ্জা করে না?” তারপর জর্জদার দিকে ফিরে বললেন, “একটা তোষক, একটা বালিশ কেনবার পয়সা নেই তোমার; তাহলে আমার ঘর থেকে এনে ওনাকে দিও।” জর্জদা গম্ভীর স্বরে উত্তর দিলেন, “তোমার পরামর্শ দিতে হবে না, তুমি যাও - ও এমনি থাকতে পারবে, না পারলে চলে যাবে।” একটু চুপ করে বলাই বাবুকে আরো বললেন, “ওইসব জিনিসপত্র আমি মনে করি বাহুল্য, রিলেটিভ।” অর্থাৎ কিনা আপেক্ষিক। বলাই বাবু ও ছাড়পার পাত্র নন। আর এক ধাপ গলা চড়িয়ে বললেন, “তাহলে পরবার লুঙ্গি খানা খুলে কৌপীন পরে থাকো। বাসে উঠে বাসের গদিটি উঠিয়ে বসো - সবই তো রিলেটিভ।” জর্জদা ততোধিক গম্ভীর হয়ে উত্তর দিলেন, “ভেবে দেখব।”
নমস্কারান্তে,
জয়ন্তানুজ ঘোষ
১৬ই, ডিসেম্বর, ২০২৩
7 сен 2024