প্রকাশিত হলো ‘৭০ এর দশকে জর্জদা’-র ৩৩-তম পর্ব। এই পর্বে দেবব্রত বিশ্বাসের কন্ঠে রইল গ্রীষ্মকালের কয়েকটি রবীন্দ্রসংগীত। গানগুলি স্বল্পশ্রুত, তাই শ্রোতাদের মন ছুঁয়ে যাবে, বলাই বাহুল্য।
বৈশাখের এই রুদ্র রূপের সঙ্গে মিলিয়ে আজকে যে সকল গল্প আপনাদের বলব, তা রবীন্দ্রনাথ এবং জর্জ বিশ্বাসের রুদ্র রূপের পরিচায়ক। আপনারা সকলেই জানেন রবীন্দ্রনাথ এবং দেবব্রত দুজনেই কোমল স্বভাব সম্পন্ন মানুষ ছিলেন। অত্যন্ত বিরক্ত না হলে তাঁদের আগুন-ঝরা রূপ কেউ দেখতে পেতেন না। বরঞ্চ রস ও রসিকতায় নিজেদের স্বরূপ এঁরা আড়াল করে রাখতেই পছন্দ করতেন। তবু কিছু অবিবেচক মানুষের অবিমৃষ্যকারী ব্যবহারের কারণে কখনো কখনো এঁদের ক্রুদ্ধ হতে দেখা গেছে কখনোসখনো। আজ সেই রকমই কয়েকটি ঘটনা বলি।
শান্তিনিকেতনে নিজের বাসভবন উত্তরায়ণ-এ বসে রবীন্দ্রনাথ সদ্য একটি গান রচনা সম্পন্ন করেছেন। আশ্রম-কন্যা সন্তানসমা কয়েকজন কে গানটি না তুলিয়ে তাঁর শান্তি নেই। সেইমত ডেকে নিলেন কয়েকটি কিন্নরকণ্ঠী আশ্রমিক কে - যার মধ্যে একজন ইন্দুলেখা ঘোষ। রবীন্দ্রনাথ যখন গান শেখাচ্ছেন, তখন অন্য এক আশ্রমিক, যাকে ডাকা হয়নি, সে এসে উপস্থিত। গুরুদেব আরামকেদারায়, মেয়ের দল তাঁর পায়ের কাছে। ছেলেটি তাই দরজার কাছে বসে রবীন্দ্রনাথের গান শেখানো মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলো। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ডাকেননি - বিরক্ত হলেও মুখে কিছু বললেন না। মেয়েদের গান তোলাতে লাগলেন। এরপর আশ্রমকন্যারা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গানটি গাইতে শুরু করল। সেই ছেলেটিও উচ্চস্বরে গলা মেলালো তাঁদের সঙ্গে। এইবার রবীন্দ্রনাথ সত্যিই বিরক্ত হলেন। একধাপ গলা উঠিয়ে বললেন - “আঃ, তুই চুপ করবি? বড্ড বেসুরো চ্যাঁচাস !”
আরও একবার রবীন্দ্রনাথকে রুদ্র রূপ ধারণ করতে দেখা গিয়েছিল যখন এক মাস্টারমশাই, যিনি গানের সুর ও স্বরলিপি নিয়ে যার পর নাই খুঁতখুঁতে ছিলেন, তিনি নিজের স্পর্ধা অতিক্রম করে রবীন্দ্রনাথকে নিতান্ত অবিবেচকের মত উপদেশ দিতে গিয়েছিলেন। ঘটনাটি এইরকম - রবীন্দ্রনাথ সেদিনও গান শেখাচ্ছেন কয়েকজন আশ্রমিককে। এই মাস্টারমশাই গানটি আগে শুনেছিলেন। তাঁর মনে হল রবীন্দ্রনাথ সুরে ভুল করছেন! তিনি ণত্ব- ষত্ব জ্ঞান ভুলে আগ বাড়িয়ে রবীন্দ্রনাথকে সকলের সামনে বলে বসলেন, “গুরুদেব আপনার সুরে ভুল হচ্ছে। স্বরলিপিতে এই রকম আছে”। কেবল এখানেই থামলেন না, রবীন্দ্রনাথকে সঠিক সুর কি হবে দেখিয়ে দিতে গেলেন। ভাবতে অবাক লাগে, রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্রষ্টাকে সুর নিয়ে সতর্ক করছেন জনৈক মাস্টারমশাই ! রুদ্ররূপী রবীন্দ্রনাথ বড় বড় চোখে সেই অবিমৃষ্যকারীকে ধমক দিয়ে বললেন, “আমার পাঁঠা - আমি ল্যাজে কাটব না মাথায় কাটব, তাতে তোমার কি? তুমি নিজের কাজ কর গিয়ে - যাও।” রবীন্দ্রনাথ উচ্চস্বরে কথা কদাচ বলতেন না। তবুও কিছু অনভিপ্রেত ঘটনা, যখন তাঁর ধৈর্যচ্যুতি ঘটিয়েছে, তখন তিনি তাঁর কঠিন রূপ প্রকাশ করেছেন।
এবার আসি জর্জদার গল্পে।
সেদিন জর্জদার খুবই শরীর খারাপ। হাঁপানির টানে ব্যতিব্যস্ত। ঘন ঘন ইনহেলার নিচ্ছেন। গম্ভীর মুখে ইজিচেয়ারে বসে আছেন। এমন সময় অনাহূত, অনিমন্ত্রিত এক দম্পতির যুগলে প্রবেশ। জর্জদা এঁদের কাউকে চেনেন না। লক্ষ্য করলেন ভদ্রমহিলার কোলে একটি লোমশ সারমেয় শাবক - যেটি তার কোলে থাকতেই চাইছে না - প্রতি মুহূর্তে লাফিয়ে কোল থেকে নেমে পড়তে চাইছে। জর্জদার সারমেয়-প্রীতি ছিল কিনা জানিনা - তবে একটি কুকুরকে নাকি তাঁর বাড়ির দরজায় শুয়ে থাকতে দেখা যেত। সুতরাং ধরে নিতে পারি তাঁর এ ব্যাপারে প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় ছিল। তবু নিজস্ব মনস্তাত্ত্বিক অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারি, হাঁপানি রুগির পক্ষে লোমশ কোনো প্রাণী, মনে কিঞ্চিৎ ভীতি সঞ্চার তো করেই। যাই হোক নিজেদের পরিচয় দিয়ে সেই দম্পতি জানালেন যে তারা একটি অনুষ্ঠান করতে চলেছেন পরের দিন এবং তারা দেবব্রত বিশ্বাসকে গায়ক হিসেবে পেতে চান। দেবব্রত বিশ্বাস প্রথম থেকেই বিরক্ত হয়েছিলেন এঁদের ব্যবহারে, তাই যথেষ্ট ভদ্রভাবে বলে দিলেন যে তাঁর শরীর নিতান্তই খারাপ - তিনি যেতে পারবেন না। এইবার ভদ্রমহিলা কোলের কুকুরটি নামিয়ে অত্যন্ত আদুরে গলায় দেবব্রত বিশ্বাসের হাত ধরে বললেন, “ওসব বললে শুনব না - আপনাকে যেতেই হবে।” বিরক্ত দেবব্রত হাত সরিয়ে নিয়ে ভদ্রমহিলার দিকে অবাক হয়ে চাইলেন। তখন তাঁর স্বামী বললেন, “আপনাকে তো কাল যেতেই হবে, আপনার নামে তো টিকিট ছাপিয়ে বিক্রিও করা হয়ে গেছে।” এইবার দেবব্রত বিশ্বাস তাঁর স্বরূপ ধরলেন। “আমার নাম করে আপনারা টিকিট বিক্রি করসেন? ক্যান? কোন সাহসে? আমারে জিগাইসিলেন? পারমিশন নিসিলেন আমার? আমি কি আপনাগো কখনো কইসি যে আপনাগো অনুষ্ঠানে আমি গামু?” যে মানুষটি এতক্ষণ হাঁপানির টানে প্রায় নির্বাক হয়ে ছিল, তাঁর এই রুদ্র-রূপ দেখে দম্পতি যুগলের তখন পালাই পালাই অবস্থা। ইতিমধ্যে কোলের থেকে নেমে পড়ে সারমেয় শাবকটি ঘরে ছুটোছুটি লাগিয়ে তুলকালাম শুরু করে দিয়েছে - জর্জদার আপাত অগোছালো ঘরে সে রীতিমত দৌড়ঝাঁপ করা শুরু করেছে। তাই দেখে জর্জদার রাগের পারদ আরেক ধাপ ওপরে উঠল। বললেন, “কুত্তা লইয়া আমার ঘরে আইসেন ক্যান?” ভদ্রলোক নিজের স্ত্রীকে দেখিয়ে বললেন, “আসলে ওর তো কোনও ছেলেপুলে নেই; তাই…”। শেষ করতে দিলেন না দেবব্রত বিশ্বাস। বজ্রকঠিন স্বরে ঘরের দরজার দিকে আঙুল তুলে বললেন, “বাইরান আমার ঘর থিকা এই মুহূর্তে। আর কোনোদিন এই ঘরে যদি পা রাখসেন…” পলায়মান দম্পতি দরজার বাইরে বেরতে বেরতে শুনতে পেলেন জর্জদার শেষ বজ্রনির্ঘোষে - “পোলা মাইয়া নাই, তো কুত্তা কেন? মাইনষের বাচ্চা পোষতে পারেন না?”
বলা বাহুল্য এবারের গানগুলি, যার সংগ্রহ থেকে আপনাদের করকমলে তুলে দিতে সক্ষম হলাম তিনি আপনাদের অতি পরিচিত, দেবব্রত বিশ্বাসের স্নেহধন্য, প্রাক্তন আইএএস শ্রী অধীপ চৌধুরী মহাশয়। তাঁর স্নেহ ও প্রশ্রয় না পেলে আমার দেবব্রত বিশ্বাসকে নিয়ে এই মহাযজ্ঞের ঋত্বিক হওয়ার সাহস হত না। তাই পিতৃপ্রতিম অধীপ বাবুকে প্রতিবারের মত আমার শতকোটি প্রণাম নিবেদন করছি। আর দেবব্রত বিশ্বাসকে বলি, ‘তোমার যজ্ঞে দিয়েছ ভার বাজাই আমি বাঁশি, (তোমার) গানে গানে গেঁথে বেড়াই প্রাণের কান্নাহাসি।’
নমস্কারান্তে,
জয়ন্তানুজ ঘোষ
১লা মে, ২০২৪
17 окт 2024