১৯৫১ - র অগাষ্টের এক সকাল। কলকাতার হেষ্টিংসের বাড়ির ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে , চোখ .পড়ল লন্ডন টাইমসের একটা আর্টিকেলের উপর। মুহুর্তে মাথার পোকা নড়ে উঠল বছর চৌত্রিশের তরতাজা এক বাঙালি যুবকের। সেবার এরিক শিপটনের নেতৃত্বে ব্রিটিশ দল চলেছে নেপালের দিক থেকে মাউন্ট এভারেস্ট অভিযানের পথ খুঁজতে। সেই যুবক তড়িঘড়ি ছুটলেন তাঁর অফিসে। অফিসকে বোঝালেন ঐ ঐতিহাসিক অভিযানে কেন একজন ভারতীয়ের অংশগ্রহন করা উচিত। কিন্তু প্রায় চার মাসের ছুটি কি সহজে ম্যানেজ হয়! বহু কাঠখড় পুড়িয়ে মিলল ছুটি। ইতিমধ্যে চিঠিতে শিপটনের সাথে যোগাযোগ সেরে ফেলেছেন উদ্যমী যুবক।
২-র সেপ্টেম্বার তিনি রওনা হলেন কলকাতা থেকে। লাগেজে ঢুকিয়ে নিলেন একটা সেকন্ড হ্যান্ড স্লিপিং ব্যাগ ও পুরানো একটা এয়ার বেড। প্রথমে পৌছলেন পূর্ণিয়ার যোগবানিতে। ওখান থেকে হাঁটা শুরু। এরিক শিপটন, দলবল নিয়ে ততদিনে বেরিয়ে গেছেন যোগবানি থেকে। না দমে দ্বিগুন উৎসাহে গাইড ছাড়াই বেড়িয়ে পড়লেন। মরিয়া হয়ে ১৫৫ মাইল সোলো ট্রেক করে নামচেবাজারে মি. শিপটনকে ধরে ফেললেন। ২৫ শে সেপ্টেম্বর তিনি দলের সাথে এভারেস্ট বেসক্যাম্পে পৌছান। যুবকের নাম গোপেন্দ্রনাথ দত্ত। পেশায় জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া র জিওলজিস্ট।
২-রা অক্টোবার বেসক্যাম্পে একটা রেস্ট ডে। সেদিনেই এভারেস্টের অজানা পথের সন্ধানে একা পুমোরির গা ধরে ২০,০০০ ফুট উঠে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করেন খুম্বু হিমবাহ। বুঝলেন খুম্বু ছাড়া আর কোন পথ নেই এভারেস্ট ক্লাইম্ব করার। রুট ওপেনের কাজ শুরু হল। শিপটন গোপেন্দ্রনাথকে পাঠালেন বিকল্প পথের হদিস করতে। শ্রী দত্ত চলে গেলেন ইমজা ভ্যালিতে। সেখানেই 6th Oct তিনি একটা শৃঙ্গ চড়ে বসেন। ভারতীয় পর্বতারোহনে ওটাই প্রথম সোলো এবং ভার্জিন পর্বত অভিযান। পরে শিপটন পর্বতটির নাম দেন আইল্যান্ড পিক। মাত্র ৪ মাস আগে মাউন্ট ত্রিশুলে প্রথম ভারতীয় সফল অভিযান করেন গুরদয়াল সিং। আর গোপেন্দ্রনাথ দত্তই প্রথম বাঙালি পর্বতারোহী।
১৯৫৩ সালে ব্রিটিশদের এভারেস্ট জয় বা জার্মানদের নাঙ্গা বিজয় নিয়ে যখন পৃথিবী উত্তাল, তখন সম্পূর্ন ভারতীয়দের দ্বারা ভারতের প্রথম অসামরিক অভিযানে নেতৃত্ব দেন গোপেন্দ্র ণাথ দত্ত সিকিমের পান্ডিম পর্বতে। পশ্চিমবঙ্গের রূপকার ডঃ বিধান চন্দ্র রায় ও তেনজিং নোরগে ঐ অভিযানে সক্রিয় সহযোগীতা করেন। ১৯৫৮ তে ইউরোপের ম্যাটারহর্ণ ক্লাইম্ব করেন শ্রী দত্ত। এছাড়া বহু এক্সপেডিশন , এক্সপ্লোরেশন ও লেখালেখি নিয়ে বুঁদ হয়ে থাকতেন। এমনকি পাহাড় পাগল লোকটা বিয়ের পর বৌকে নিয়ে ১৯৪৯ সালে গোমুখে হানিমুনে চলে যান।
কিন্তু অদ্ভুতভাবে বাংলার তথা ভারতের পর্বতারোহনের ইতিহাসের প্রাণপুরুষ চাপা পরেছেন বিস্মৃতির অতলে। তাঁর অভিযানের কাহিনি যদি আবারও নতুন করে লেখা হয়, তবে বহু সফল ভারতীয় পর্বতারোহীর নামের আগে তাঁর নাম থাকবে। ডক্টর গোপেন্দ্র নাথ দত্ত, এই নামটাকে আজ আমরা একরকম ভূলতে বসেছি। সত্তরের দশকের শেষ দিক থেকে কোন এক অজ্ঞাত কারণে তিনি আজও নিরুদ্দেশে। সাথে সাথে দেশের প্রথম দিককার পর্বত অভিযানের ইতিহাস আজ অবলুপ্তির পথে। সোনারপুর আরোহী আরো একবার ডক্টর গোপেন্দ্র নাথ দত্তকে সশ্রদ্ধ শ্রদ্ধা জানিয়ে সেই চাপা পড়া ইতিহাসের পুণ্রুদ্ধারের কাজ শুরু করল। আপনিও আমাদের পাশে থাকুন।
22 сен 2024