ভাটির বাঘ শমসের গাজী অকালে হারিয়ে যাওয়া
ইতিহাসের এক মহানায়ক
অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে, দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার এক খ্যাতিমান বীরপুরুষ, সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা এক প্রজাদরদী শাসক, সমগ্র ত্রিপুরা রাজ্য, বৃহত্তর নোয়াখালী-কুমিল্লা সহ সিলেট ও চট্টগ্রামের একটি বৃহৎ অংশের দাপুটে শাসক, ভাটির বাঘ ও ছানি নবাব খ্যাত বীর শমসের গাজীর ধ্বংশ হয়ে যাওয়া রাজবাড়িতে।
রাজবাড়িটির অবস্থান ফেনী জেলার, ছাগলনাইয়া উপজেলার, শুভপুর ইউনিয়নের জগন্নাথ সোনাপুর গ্রামের বাংলাদেশ ভারত সীমান্তবর্তী নো ম্যান্স ল্যান্ডে।
আমরা ৬ জন বন্ধু ছাগলনাইয়া উপজেলা সদরের কলেজ রোডস্থ ও জিরো পয়েন্ট সংলগ্ন ভাইভাই মেডিকেল হলের সামনে থেকে বিকাল তিনটায় রওয়ানা করলাম গাজীর রাজবাড়ির উদ্দেশ্যে। যেতে যেহেতু তেমন সময় লাগবেনা তাই পথে শমসের গাজী কতৃক খননকৃত বিখ্যাত কৈয়ারা দিঘির ঘাটে একটু যাত্রাবিরতি করলাম। দক্ষিণ মন্দিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন এক গ্রামীণ দোকানে চা পান পরবর্তী সেলফি পর্বটিও দারুণ ছিল। কৈয়ারা বিবি ছিল শমসের গাজীর মায়ের নাম। মূলত এলাকার বাসিন্দাদের বিশুদ্ধ পানির সংকট নিরসনে শমশের গাজী তার মায়ের নামে এ দিঘিটি খনন করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন । অত্র এলাকার একটি সুবৃহৎ জলাধার হিসেবে যা এখনো টিকে আছে ইতিহাসের অনন্য নিদর্শন হিসেবে।
কৈয়ারা দিঘির ঘাটে কিছু সময় অবস্থান করে আমরা ছুটে চললাম গাজীর রাজবাড়ীর দিকে। ছাগলনাইয়া- শুভপুর রোডের চম্পকনগর নামক স্থানে বামে মোড় নিয়ে আমরা আস্তে আস্তে এগুতে থাকলাম কাঙ্খিত গন্তব্যের দিকে। গ্রামের সবুজ, সুন্দর ও কোমল পরিবেশ আমাদের মন প্রাণ সতেজ করে দিচ্ছিল।
চম্পকনগর মোড় থেকে পূর্ব দিকে প্রায় দুই কিলোমিটার আসার পর আমরা পৌঁছলাম সেই কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। আজ শুক্রবার অর্থাৎ ছুটির দিন হাওয়ায় এখানে পর্যটকের আনাগোনা অন্যান্য দিনের চেয়ে অনেক বেশি। আমরা একে একে পরিদর্শন করলাম বিখ্যাত একখুইল্লা দিঘি, রহস্যময় সুড়ঙ্গ, রাঙ্গামাটিয়া দিঘি, নর্দমা দিঘি সহ গাজীর স্মৃতি মিশে থাকা বিপ্লবী মাটির নানান অনুষঙ্গ।
শমসের গাজীর পরিবার মূলত নোয়াখালীর ওমরাবাদ পরগনা থেকে ফেনীর বেদরাবাদ পরগনা যা বর্তমানে ছাগলনাইয়া উপজেলার দক্ষিণ অংশে পড়েছে সেখানকার নিজকুঞ্জরা গ্রামে এসে বসবাস শুরু করে। সেই নিজকুঞ্জরা গ্রামেই ১৭০৬ সালে শমসের জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল পীর মোহাম্মদ। সেখানে ফেনী নদীর তীর থেকে একদিন শমশেরকে নিজ গৃহে নিয়ে আসেন শুভপুরের তালুকদার জগন্নাথ সেন। জগন্নাথ সেন ও তার স্ত্রী সোনা বিবির স্নেহে বড় হতে থাকেন তিনি । লাঠি খেলা, তীর ধনুক চালনা, হিসাব নিকাশ বিদ্যা ইত্যাদি জ্ঞানে আস্তে আস্তে সমৃদ্ধ হতে থাকেন। হঠাৎ তালুকদার জগন্নাথ সেন মৃত্যুবরণ করলে শমশের গাজী উক্ত এলাকার তালুকদার হিসেবে নিয়োজিত হন।
পরবর্তীতে দক্ষিণ শিক পরগনার জমিদার নাসির মোহাম্মদ এর সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে নাসির মোহাম্মদকে হত্যা করা হলে শমসের গাজী দক্ষিণ শিক পরগণার জমিদারিও লাভ করেন। তারপর একে একে সমগ্র চাকলা রৌশনাবাদ, বৃহত্তর নোয়াখালী, কুমিল্লার মেহেরকুল ইত্যাদি অঞ্চল গাজীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এক সময় সমগ্র ত্রিপুরার শাসনদণ্ডও শমশের গাজীর হস্তগত হয়।
১৭৪৮ থেকে ১৭৬১ সাল পর্যন্ত শমশের গাজী বৃহত্তর ত্রিপুরার শাসক ছিলেন। তবে তিনি ত্রিপুরার রাজধানী উদয়পুরে বসবাস করতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন না। সে কারণে এবং বিদ্রোহ দমনের কৌশল হিসেবে উদয়পুরে লক্ষণ মানিক্য নামে একজনকে সাক্ষী গোপাল রাজা হিসেবে নিয়োগ করে তিনি এ জগন্নাথ সোনাপুরেই অবস্থান করতেন। এক পর্যায়ে সিলেটের একটি বৃহৎ অংশ এবং চট্টগ্রামের উত্তরাঞ্চলও শমসের গাজীর দখলে চলে আসে।
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় ইংরেজ প্রভাব দিন দিন বাড়তে থাকে। অন্যদিকে যুগ যুগ ধরে ত্রিপুরা শাসন করা মানিক্য রাজবংশের শাসকদের উত্তরসুরিরাও শমসের গাজীর হাত থেকে ত্রিপুরাকে উদ্ধার করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে। অবশেষে ১৭৬১ সালে নানামুখী ষড়যন্ত্রের মুখে শমসের গাজিকে মুর্শিদাবাদ অথবা রংপুরে তোপের মুখে হত্যা করা হয়। এর মধ্য দিয়ে অবসান হয় উল্কার বেগে উত্থিত হওয়া সুবিশাল অঞ্চলের এক দাপুটে শাসকের এক যুগেরও বেশি সময়ের বর্ণিল শাসনের।
গাজীর মত প্রজাদরদী শাসক তখনকার সময়ে ছিল না বললেই চলে। তিনি গরিব ও অসহায় প্রজাদের খাজনা মওকুফ করে দিতেন এবং নিজ তহবিল থেকে দান করতেন অকাতরে। তাছাড়া সেই সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে শমশের গাজী ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুদূরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শিক্ষক নিয়ে এসেছিলেন এলাকার শিক্ষার বিস্তারকল্পে। আজকে থেকে প্রায় ৩০০ বছর আগেও শমসের গাজী একজন শ্রেষ্ঠ অর্থনীতিবীদের মত বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছিলেন সফলভাবে। যা এই আধুনিক সময়েও কল্পনা করা যায় না। তিনি বাজারে প্রত্যেকটি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে তালিকা ঝুলিয়ে দিতেন। এরচেয়ে বেশি দামে কোন বিক্রেতা পণ্য বিক্রি করলে তার কঠিন শাস্তি হতো। বাজার পর্যবেক্ষণের জন্য ছিলো গোয়েন্দা বাহিনী। শমসের গাজীর সময়ে বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের তালিকা আমরা বিভিন্ন ইতিহাসের গ্রন্থে উল্লেখ পাই।
সর্বশেষ বলা যায়, ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলার জীবন দানের পরে ঔপনিবেশিক শক্তির হাতে একটি সুবিশাল অঞ্চলের শাসক হিসেবে ২য় শহীদ হিসেবে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন শমসের গাজী। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, শমসের গাজীর সংগ্রাম, অর্জন ও অবদানের সোনালি অধ্যায়গুলো আমাদের জাতীয় ইতিহাসের গ্রন্থসমূহে খুব একটি স্থান পায়নি। আমরা যদি আমাদের বীর পূর্বপুরুষদের ইতিহাসকে এভাবে অবজ্ঞা করতে থাকি, একসময় আমাদেরকে এর জন্য অনুতপ্ত হতে হবে।
সুপ্রিয় দর্শক, বীর শমসের গাজীর সুবিশাল ও সুদীর্ঘ বীরত্বগাঁথার চুম্বক অংশ আজ আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি। আল্লাহ হাফেজ।
#feni #chattogram #history #tripura #shilapath #shamsergazi #chhagalnaiya
@Shilapath @HISTORY
27 авг 2024