১৩৫৬ বঙ্গাব্দের ১৮ই বৈশাখ, রবিবার পুণ্য অক্ষয় তৃতীয়া তিথিতে মাহেন্দ্রক্ষণে ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের পহেলা মে অগণিত ভক্তের প্রাণের ঠাকুর নশ্বর দেহ ত্যাগ করিয়া অপ্রকট হইলেন। ৯০ বৎসর পূর্বে এই শুভ অক্ষয় তৃতীয়ায় তিনি মাতৃজঠরে প্রবিষ্ট হইয়াছিলেন, ঠাকুর নিজ মুখেই ইহা ব্যক্ত করিয়াছিলেন। দেহরক্ষার পূর্ব দিন রাত্রিতে ঠাকুর যখন শয়ন করিবেন, তাহার পূর্বক্ষণে উপেন বাবু ও নরেন বাবুকে বলিলেন, “গত রাত্রিশেষে আমি তন্দ্রার ঘোরে দেখিলাম চন্দ্রলোক হইতে একখানা রথ নামিয়া আসিল, আমি তাহাতে উঠিয়া এখান হইতে চলিয়া গেলাম।” ঠাকুর পদ্মহস্ত তাঁহাদের মাথায় রাখিয়া আশীর্বাদ জানাইলেন, কখন বা চিবুক ধরিয়া আদর জানাইলেন এবং মঙ্গল কামনা করিলেন।
ঠাকুরের পাঞ্চভৌতিক দেহ দাহ কি সমাধিস্থ করা হইবে এবং সে কার্যটি কোথায় সম্পন্ন করা হইবে, এই প্রশ্নের সমাধান বিষয়ে ভক্তগণের মতভেদ উপস্থিত হইল। উপেন্দ্র বাবু ও নরেন্দ্র বাবু বলিলেন, ঠাকুর একদিন বলিয়াছিলেন তাঁহার দেহ যেন চৌমুহনী আশ্রমেই সমাধিস্থ করা হয়। পক্ষান্তরে ফেনীর ভক্তগণ বলিলেন, ঠাকুর বলিয়াছিলেন, “দেহ হইতে প্রাণ বাহির হইয়া গেলে এই পাঞ্চভৌতিক দেহ ত্যজ্য পদার্থে পরিণত হয়, তখন ইচ্ছা হয় ইহা মাটিতে পুঁথিয়া রাখেন, ইচ্ছা হয় নদীতে ভাসাইয়া দেন, ইচ্ছা হয় আগুনে ভষ্ম করিয়া ফেলেন।” ঠাকুরের কথায় এইরূপ ইঙ্গিত ছিল যে, তাঁহার দেহ ফেনীর মাটিতেই রাখা হয়। মোহন্ত মহারাজ শ্রীমৎ শ্যামাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের উপর এই সমস্যা সমাধানের ভার ন্যস্ত হইল। তিনি কিয়ৎকাল ধ্যানস্থ থাকিয়া এই প্রত্যাদেশ পাইলেন যে, চৌমুহনীতেই সমাধিস্থ করা হইবে। সকলে সন্তুষ্ট চিত্তে এই মীমাংসাই স্বীকার করিয়া লইলেন।
বাংলোর যে কক্ষে ঠাকুর বাস করিতেন সে কক্ষই সর্বসম্মতিক্রমে সমাধিক্ষেত্র নির্বাচিত হইল। অতি অল্প সময়ের মধ্যে তাঁহারই কৃপায় চারি হাত দৈর্ঘ্য, চারি হাত প্রস্থ ও চারি হাত গভীর একটি গর্ত করিয়া এবং তাহার চতুর্দিক ও নিম্নভাগ ইট, সুরকী ও সিমেন্ট ইত্যাদি দ্বারা বেশ শক্ত করিয়া বাঁধাইয়া, ঠাকুর যে খাটে, যে শয্যায় এবং যে মশারীর নীচে শয়ন করিতেন সেই সব জিনিষ সহ এবং তাঁহার নিত্য ব্যবহার্য আরও কতকগুলি জিনিষ পাশে রাখিয়া চিরভক্ত বাঞ্ছিত পবিত্র দেহ সমাধিস্থ করা হইল। এবং গৃহ ভিত্তি হইতে দুই হাত উচ্চ এক বেদি নির্মাণ করিয়া সমাধি ঢাকিয়া দেওয়া হইল। মহাপ্রয়াণের পূর্বে ঠাকুর উপেন্দ্র বাবুকে একখানা নিত্য ব্যবহার্য কম্বল দেখাইয়া বলিয়াছিলেন, “গঙ্গার পাড়ে ঠাণ্ডা বাতাস, এই কম্বলখানা যেন সঙ্গে দেন।” কিন্তু প্রবল মানসিক চাঞ্চল্য হেতু উহা দিতে কাহারও স্মরণ ছিল না। ভক্তগণ একদিকে শোকাশ্রু, অপর দিকে প্রেমাশ্রু বিসর্জন করিতে করিতে হরিনাম কীর্তন ও মুহুর্মুহু হুলুধ্বনির মধ্যে সেই পরম পবিত্র, একান্ত বাঞ্ছিত ও চির সেবিত দেহখানা সমাধিস্থ করিলেন।
তিনি যে গৃহে ছিলেন তাহা যথাসম্ভব তদবস্থায় রাখা যদিও সকলেরই বাঞ্ছিত ছিল, কিন্তু আলোচনার পর নূতন একটি সুরম্য ইষ্টক নির্মিত মন্দির নির্মাণ করাই সাব্যস্ত হইল, কারণ ক্ষয়শীল টালির ছাদের ও বাঁশের বেড়ার ঘর খুব বেশি দিন ঠিক অবস্থায় রাখা অসম্ভব। সুতরাং উপস্থিত ভক্তমাত্রই নূতন পাকা মন্দির নির্মাণ করাই স্থির করিল।
অতি অল্প সময়ের মধ্যেই শ্রীশ্রীঠাকুরের আশ্রিত কুমিল্লা ডিষ্ট্রিক্ট বোর্ডের ইঞ্জিনিয়ার শ্রীযুত সুধীররঞ্জন সেন মহাশয়ের দ্বারা সুচিন্তিত একটি সুন্দর প্ল্যান (নক্সা) প্রস্তুত করাইয়া বর্তমান সুরম্য মন্দির নির্ম্মিত হইল। ঐ মন্দিরটির চতুর্দ্দিক ঘেরিয়া খোলা প্রশস্ত বারান্দা সমাধিস্থান প্রদক্ষিণ করার বিশেষ সুযোগ সুবিধা দিয়েছে। সম্মুখের অর্থাৎ দক্ষিণ দিকের বারান্দা এমনই প্রশস্ত যে, প্রায় একশত লোক তথায় বসিয়া পরমানন্দে কীর্ত্তনাদি করিতে পারে। তথায় প্রত্যহই সকাল, মধ্যাহ্ন ও সন্ধ্যায় পূজা আরতি আদির সময় কীর্ত্তন হইয়া থাকে। মন্দিরের ঠিক মধ্যস্থলে সমাধিস্থানের উপরে চারফুট উচ্চ সুবৃহৎ ইষ্টক নির্ম্মিত বাঁধানো স্থানের উপরিভাগ বিভিন্ন সময় নানা সুন্দর বর্ণের কাপড় দ্বারা ঢাকা থাকে।
ঐ মন্দির সর্ব্বোচ্চ গম্বুজ সহ ৭২/৭৩ ফিট উঁচু হইয়াছে। সর্ব্বোচ্চ গম্বুজের উপর ইলেকট্রিক লাইট স্থাপন করায় তাহা বহুদূর হইতে দৃষ্ট হয় এবং উৎসবাদির সময় মন্দিরের গায়ে নানা স্থানে ইলেকট্রিক বাল্ব লাগাইয়া আলোকিত করিলে অতি মনোরম প্রতিভাত হয়। মন্দিরাভ্যন্তরে এবং বারান্দায় নানা শাস্ত্রবাক্য উদ্ধৃত করিয়া সুন্দরভাবে লেখা হইয়াছে। মন্দিরের সম্মুখে “জয় গোবিন্দ” এমন সুন্দর বৃহদাকারে লেখা হইয়াছে যে, তাহা বহুদূর হইতে দৃষ্ট হয় এবং শ্রীশ্রীঠাকুরের শ্রীচরণ ভক্তগণ স্পর্শ করিলে তিনি যাহা বলিয়া আশীর্ব্বাদ করিতেন সেই অতি পবিত্র মধুর আশীর্ব্বাদ বাণীর স্মৃতি জাগ্রত হইয়া তাহাদিগকে আনন্দে আপ্লুত করে।
12 сен 2024