তাফসীর
সূরা ফালাক ও পরবর্তী সূরা নাস একই সাথে একই ঘটনায় অবতীর্ণ হয়েছে। হাফেয ইবনে কাইয়্যেম (রহঃ) উভয় সূরার তাফসীর একত্রে লিখেছেন। তাতে বলেছেন যে, এ সূরাদ্বয়ের উপকারিতা ও কল্যাণ অপরিসীম এবং মানুষের জন্যে এ দুটি সূরার প্রয়োজন অত্যাধিক। বদনজর এবং সমস্ত দৈহিক ও আত্মিক অনিষ্ট দূর করায় এ সূরাদ্বয়ের কার্যকারিতা অনেক। বলতে গেলে মানুষের জন্যে শ্বাস-প্রশ্বাস, পানাহার ও পোশাক-পরিচ্ছদ যতটুকু প্রয়োজনীয়, এ সূরাদ্বয় তার চেয়ে বেশী প্রয়োজনীয়।
মুসনাদে আহমদে বর্ণিত আছে, জনৈক ইহুদী রসুলুল্লাহ্ (সাঃ) - এর উপর জাদু করেছিল। ফলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। জিবরাঈল আগমন করে সংবাদ দিলেন যে, জনৈক ইহুদী জাদু করেছে এবং যে জিনিসে জাদু করা হয়েছে, তা অমুক কুপের মধ্যে আছে। রসুলুল্লাহ (সাঃ) লোক পাঠিয়ে সেই জিনিস কুপ থেকে উদ্ধার করে আনলেন। তাতে কয়েকটি গ্রন্থি ছিল। তিনি গ্রন্থিগুলো খুলে দেয়ার সাথে সাথে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে শয্যা ত্যাগ করেন। জিবরাঈল ইহুদীর নাম বলে দিয়েছিলেন এবং রসুলুল্লাহ (সাঃ) তাকে চিনতেন। কিন্তু ব্যক্তিগত ব্যাপারে কারও কাছ থেকে প্রতিশোধ নেয়ার অভ্যাস তার কোন দিনই ছিল না। তাই আজীবন এই ইহুদীকে কিছু বলেননি এবং তার উপস্থিতিতে মুখমণ্ডলে কোনরূপ অভিযোগের চিহ্নও প্রকাশ করেননি। কপটবিশ্বাসী হওয়ার কারণে ইহুদী রীতিমত দরবারে হাযির হত।
সহীহ্ বোখারীতে হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, রসুলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর উপর জনৈক ইহুদী জাদু করলে তার প্রভাবে তিনি মাঝে মাঝে দিশেহারা হয়ে পড়তেন এবং যে কাজটি করেননি, তাও করেছেন বলে অনুভব করতেন। একদিন তিনি হযরত আয়েশা (রাঃ)-কে বললেনঃ আমার রোগটা কি, আল্লাহ্ তায়ালা তা আমাকে বলে দিয়েছেন। (স্বপ্নে) দুব্যক্তি আমার কাছে আসল এবং একজন শিয়রের কাছে ও অন্যজন পায়ের কাছে বসে গেল। শিয়রের কাছে উপবিষ্ট ব্যক্তি অন্য জনকে বলল, তার অসুখটা কি? অন্যজন বললঃ ইনি জাদুগ্রস্থ। প্রথম ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলঃ কে জাদু করল? উত্তর হল, ইহুদীদের মিত্র মুনাফিক লবীদ ইনবে আ’সাম জাদু করেছে। আবার প্রশ্ন হলঃ কি বস্তুতে জাদু করেছে? উত্তর হল, একটি চিরুনীতে। আবার প্রশ্ন হলঃ চিরুনীটি কোথায়? উত্তর হল, খেজুর ফলের আবরনীতে ‘বির যরওয়ান’ কূপে একটি পাথরের নীচে চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। অতঃপর রসুলুল্লাহ্ (সাঃ) সে কূপে গেলেন এবং বললেনঃ স্বপ্নে আমাকে এই কুপই দেখানো হয়েছে। অতঃপর চিরুনীটি সেখান থেকে বের করে আনলেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) বললেনঃ আপনি ঘোষণা করলেন না কেন (যে, অমুক ব্যক্তি আমার উপর জাদু করেছে)? রসুলুল্লাহ্ (সাঃ) বললেনঃ আল্লাহ্ তায়ালা আমালে রোগমুক্ত করেছেন। আমি কারও জন্যে কষ্টের কারণ হতে চাই না। (উদ্দেশ্য, একথা ঘোষণা করলে মুসলমানরা তাকে হত্যা করত অথবা কষ্ট দিত।)
মুসনাদে আহমদের রেওয়ায়েতে আছে, রসুলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর এই অসুখ ছয় মাস স্থায়ী হয়েছিল। কোন কোন রেওয়ায়েতে আরও আছে যে, কতক সাহাবায়ে কেরাম জানতে পেরেছিলেন যে, এ দুষ্কর্মের হোতা লাবীদ ইবনে আ’সাম। তারা একদিন রসুলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর কাছে এসে আরয করলেনঃ আমরা এই পাপিষ্ঠকে হত্যা করব না কেন? তিনি তাঁদেরকে সে উত্তরই দিলেন, যা হযরত আয়েশা (রাঃ) -কে দিয়েছিলেন। ইমাম সা’লাবী (রহঃ) -এর রেওয়ায়েতে আছে, জনৈক বালক রসুলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর কাজকর্ম করত। ইহুদী তার মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর চিরুনী হস্তগত করতে সক্ষম হয়। অতঃপর একটি তাঁতের সূতায় এগারটি গ্রন্থি লাগিয়ে প্রত্যেক গ্রন্থিতে একটি করে সুঁই সংযুক্ত করে। চিরুনীসহ সেই তার খেজুর ফলের আবরণীতে রেখে অতঃপর একটি কূপে প্রস্তরখণ্ডের নীচে রেখে দেয়া হয়। আল্লাহ্ তায়ালা এগার আয়াতবিশিষ্ট এ দুটি সূরা নাযিল করলেন। রসুলুল্লাহ্ (সাঃ) প্রত্যেক গ্রন্থিতে এক আয়াত পাঠ করে তা খুলতে লাগলেন। গ্রন্থি খোলা সমাপ্ত হওয়ার সাথে সাথে তিনি অনুভব করলেন যেন একটি বোঝা নিজের উপর থেকে সরে গেছে। - (ইবনে-কাসীর)
জাদুগ্রস্থ হওয়া নবুওয়তের পরিপন্থী নয়ঃ
যারা জাদুর স্বরূপ সম্পর্কে অবগত নয়, তারা বিস্মিত হয় যে, আল্লাহ্র রসূলের উপর জাদু কিরূপে ক্রিয়াশীল হতে পারে। জাদুর স্বরূপ ও তার বিশদ বিবরন সূরা বাকারায় বর্ণিত হয়েছে। এখানে এতটুকু জানা জুরুরী যে, জাদুর ক্রিয়াও অগ্নি, পানি ইত্যাদি স্বাভাবিক কারনাদির ক্রিয়ার ন্যায়। অগ্নি দহন করে অথবা উত্তপ্ত করে, পানি ঠাণ্ডা করে এবং কোন কোন কারণের পরিপ্রেক্ষিতে জ্বর আনে। এগুলো সবই স্বাভাবিক ব্যাপার। পয়গম্বরগন এগুলোর ঊর্ধ্বে নন। জাদুর প্রতিক্রিয়াও এমনি ধরনের একটি ব্যাপার। কাজেই তাঁদের জাদুগ্রস্থ হওয়া অবাস্তব নয়।
14 окт 2024